বকেয়া পরিশোধে পিডিবিকে কোন আল্টিমেটাম দেয়নি আদানি গ্রুপ
আপলোড সময় :
০৩-১১-২০২৪ ১০:২৩:০৫ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
০৪-১১-২০২৪ ০২:০৪:২৯ অপরাহ্ন
বকেয়া বিল না পেলে আগামী বৃহস্পতিবার থেকে আদানি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেবে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া যে খবর প্রকাশ করেছে সেটিকে উড়িয়ে দিয়েছে আদানি গ্রুপ। বরং উল্টো চলতি সপ্তাহে বিদ্যুৎ সরবরাহ আরও বাড়ানোর প্রস্তুতি নিয়েছে ভারতীয় বিদ্যুৎ কোম্পানিটি। বিষয়টি নিশ্চিত করে রোববার (৩ নভেম্বর) সন্ধ্যায় আদানি পাওয়ারের পক্ষ থেকে বলা হয়, আগামী ৭ নভেম্বরের মধ্যে ৮০ থেকে ৮৫ কোটি ডলার বকেয়া পরিশোধ করার কোনও আল্টিমেটাম বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) দেননি তারা। বকেয়া আদায়ের জন্য পিডিবির সঙ্গে আলোচনা চলছে। দু’পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে চায় আদানি। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা আরও জানান, কয়লা আমদানি নিয়ে এলসি (ঋণপত্র) সংক্রান্ত একটা জটিলতা ছিল। সেটি দু-একদিনের মধ্যে কেটে যাবে। তখন বন্ধ থাকা দ্বিতীয় ইউনিটও চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এর পাশাপাশি এ সপ্তাহে যদি পিডিবি কিছু পেমেন্ট দেয় তাহলে পুরোদমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা শুরু হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বলেন, আদানির যে বকেয়া রয়েছে তার একটা পেমেন্ট সোমবার দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এস এস পাওয়ার প্লান্টের (এস আলমের বিদ্যুৎ কেন্দ্র) বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। আশা করছি সোমবারের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। মাতারবাড়ি ও রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রও যাতে দ্রুত উৎপাদন শুরু করতে পারে সেই প্রচেষ্টা চলছে।
ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের গোড্ডায় নির্মিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি গত বছর বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর আগেই কয়লার দাম ও চুক্তির শর্ত নিয়ে দেশ-বিদেশে শুরু হয় ব্যাপক সমালোচনা। এক পর্যায়ে পিডিবির পক্ষ থেকে আদানিকে কয়লার চড়া দাম দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর দাম কমাতে রাজি হয় আদানি। পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে কম দামে কয়লা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেয় তারা। তবে এক বছর পর এখন আবার ২২ শতাংশ বাড়তি দাম চাইছে আদানি।
পিডিবি সূত্রমতে, পটুয়াখালীর পায়রায় নির্মিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতি টন কয়লার দাম নিচ্ছে ৭৫ মার্কিন ডলার। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস এস পাওয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে টন প্রতি কয়লার দাম ৮০ ডলারের কম। আর আদানি প্রতি টন কয়লার দাম চাইছে ৯৬ ডলার।
বাড়তি দাম নিয়ে বিরোধ ও বকেয়া পরিশোধের তাগিদের মধ্যে সর্বশেষ গত ২৮ অক্টোবর পিডিবিকে চিঠি দেয় আদানি। এতে বলা হয়, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে পিডিবি বকেয়া পরিশোধ না করলে ক্রয়চুক্তি অনুযায়ী ৩১ অক্টোবর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে বাধ্য হবে আদানি। কারণ, চলতি মূলধনের সংকটে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
পিডিবি সূত্র বলছে, কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে ৩০ অক্টোবরের মধ্যে বিদ্যুৎ আমদানিতে আদানির নামে ঋণপত্র (এলসি) খোলার কথা থাকলেও ডলার সংকটের কারণে তা সম্ভব হয়নি। তখন পিডিবির পক্ষ থেকে সময় চাওয়া হয়। এরইমধ্যে বৃহস্পতিবার থেকে ১৪৯৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্রটির একটি ইউনিট বন্ধ করে দেয় আদানি। এক পর্যায়ে দ্বিতীয় ইউনিট থেকেও বিদ্যুৎ সরবরাহ কমে ৫০০ মেগাওয়াটের মতো পৌঁছায়। ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট থেকে গড়ে প্রতিদিন ১৪০০ থেকে সাড়ে ১৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসছিল।সময়মতো বিল না পাওয়ায় প্রয়োজনীয় কয়লা আমদানি করতে না পারার কারণেই এমন সংকট তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছে আদানি।
পিডিবির কর্মকর্তারা জানান, প্রতি সপ্তাহে আদানির বিল পাওনা হচ্ছে ২ কোটি ২০ লাখ থেকে আড়াই কোটি ডলার। এর বিপরীতে পিডিবি তাদের পরিশোধ করছে ১ কোটি ৮০ লাখ ডলারের মতো। আগে পরিশোধের পরিমাণ আরও কম ছিল। এতে অক্টোবর পর্যন্ত তাদের পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৫ কোটি ডলার। অক্টোবরে বাংলাদেশ আদানিকে বিদ্যুতের বকেয়া বাবদ নয় কোটি ৭০ লাখ ডলার দিয়েছে, যা আগের তিন মাসের পরিশোধের চেয়ে বেশি।
বিদ্যুৎ বিভাগ ও পিডিবির কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কোনও কারণে আদানি যদি সত্যি সত্যি বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয় তাহলে দেশে বিদ্যুতের বড় ধরনের ঘাটতির আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। বিশেষ করে ভারতীয় গণমাধ্যমে বিষয়টি ফুলিয়ে ফাপিয়ে বলা হচ্ছে-আদানির বিদ্যুৎ বন্ধ হলে বাংলাদেশের বৃহৎ অংশ অন্ধকারে ডুববে। এসব ধারণা একেবারেই অমূলক। কারণ গরম কমে যাওয়ায় বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদাও কমে গেছে। ফলে লোডশেডিং কিছুটা বাড়লেও বড় বিপর্যয়ের কোনও শঙ্কা নেই। প্রয়োজনে বিকল্প হিসেবে সাময়িক সময়ের জন্য তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালিয়ে সংকট সামাল দেওয়ার চেষ্টা করবে সরকার।
এদিকে কয়লা সংকটের কারণে এস আলম গ্রুপের ১২২৪ মেগাওয়াট ক্ষমতার এস এস পাওয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট বন্ধ থাকায় বর্তমানে কেন্দ্রটি থেকে গড়ে ৪শ থেকে ৫শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা জানান, এলসি জটিলতার কারণে তারা সময়মতো কয়লা আমদানি করতে পারেননি। আগামীকাল সেই জটিলতা কেটে যাবে। ইতোমধ্যে ৬০ হাজার ৫শ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে একটি জাহাজ দেশে এসে পৌঁছেছে। আজ তাদেরকে পেমেন্ট দেওয়ার পর দ্বিতীয় ইউনিটটিও রাতের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রস্তুত হবে। তিনি আরও জানান, আগামী ৮ নভেম্বর আরও প্রায় ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা দেশে এসে পৌঁছাবে। একইভাবে ১২ এবং ১৬ তারিখেও একই পরিমাণ কয়লা আসবে। ফলে কয়লা নিয়ে আপাতত আর সংকট থাকবে না।
পিডিবির কর্মকর্তারা জানান, মাতারবাড়িতে ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা সরবরাহে ঠিকাদার নির্বাচনে কিছু জটিলতার কারণে কেন্দ্রটির কয়লা আমদানি বেশ কিছুদিন বন্ধের কারণে পুরো কয়লা শেষ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে গত ২৫ অক্টোবর পুরোপুরি উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
তবে ঠিকদার নিয়ে জটিলতার অবসান হওয়ার পর গত সপ্তাহে কয়লা সরবরাহের জন্য চুক্তি হয়েছে। বিদেশ থেকে কয়লা আমদানির পর আগামী ২০-২৫ দিনের মধ্যে কেন্দ্রটি চালু হবে বলে আশা করছেন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা। অবশ্য কয়লা সংকটে বন্ধ হওয়ার এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কেন্দ্রটির নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের যে কাজ সেটি এখন চলছে। ফলে রক্ষণাবেক্ষনের জন্য সহসা আর এই কেন্দ্র বন্ধ করা লাগবে না।
এছাড়া কয়লা সংকটের কারণে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগে করা ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট থেকে ৬২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আসছে। আগামী ১০ নভেম্বরের পর দুটি ইউনিট চালু হওয়ার কথা রয়েছে।
দেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রেরও প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা পাওনা দাঁড়িয়েছে পিডিবির কাছে। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক রেখেছে বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। এমনকি গত ৩১ অক্টোবর থেকে কেন্দ্রটির রক্ষণাবেক্ষনের জন্য একটি ইউনিট কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়ার পরে পিডিবির অনুরোধে তা পেছানো হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ এবং বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে পিডিবিকে বিপুল পরিমাণ লোকসান গুনতে হচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে ডলার সংকট। এই কারণেই মূলত বকেয়ার পরিমাণ বাড়ছে। তারা জানান, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির কারণে কমবেশি করে বকেয়া পরিশোধ করা হচ্ছে। আদানির পাশাপাশি অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোরও বকেয়া রয়েছে। এই বকেয়াগুলো পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের।
বাংলা স্কুপ/প্রতিবেদক/এএইচ/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স